চেয়ারম্যানের বাড়ি এখন আর গ্রামের উন্নয়নের ও মানুষের সুখ দুঃখের ভাগাভাগি করার জায়গা নয়। ইউনিয়ন পরিষদ ভবনও নয় সালিশী বৈঠকে ন্যায্যবিচার পাওয়ারও জায়গা। গ্রামে কিছু ঘটলে স্থানীয়ভাবেই তার সুরাহাও হয় না। সঠিক সালিশ হয় কম,ফলে সালিশ মেনে নেয়ার সংখ্যাও কম। প্রতিপক্ষকে হেনেস্তা করার প্রতিযোগিতায় মামলা মোকদ্দমায় জড়াচ্ছে।সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত হলে নির্বাচিত নেতাগণ গ্রামের মানুষের কাছে ভালো থাকার চেষ্টা করেন। আর জনগণের ভোট গৌণ হয়ে গেলে নীতি আদর্শ থাকে শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতায়।
গ্রামের কথা মনে এলেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সুশীতল ছায়া ঘেরা কোনো দৃশ্যের ছবি। ফসলের মাঠের মাঝ দিয়ে আঁকা বাঁকা সরু মোঠো পথ। সবুজ গ্রামের মধ্যে উঁকি দেওয়া সবুজ গাছের সারি। গ্রামের মানুষগুলোও যেন ছিল একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।একে অপরের সুখে-দুখে এগিয়ে আসত।যে কোনো ধরনের সমস্যা গ্রামীণ সালিশেই সমাধান হয়ে যেত। শত্রুতা পরিণত হতো বন্ধুত্বে।কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সেই গ্রামীণ সালিশ ব্যবস্থায়ও ঢুকে পড়েছে স্বার্থপরতা, পক্ষপাতিত্ব ও অবৈধ অর্থনৈতিক লেনদেন ইত্যাদি;যা সৌহার্দপূর্ণ সেই গ্রামীণ শৃঙ্খলাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সংঘাতময় হয়ে উঠছে আমাদের গ্রামীণ রাজনীতি।মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসে ধরেছে চিড়।জনপ্রতিনিধিরা জনসেবা ছেড়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে গেছে; রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার মাত্রা বাড়িয়ে দলীয় আনুগত্যে এগিয়ে গেছে।স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়ছে ব্যাপকভাবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে বেশি পরিচিত হওয়ায় মানুষের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাবের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।গ্রামীণ নেতৃত্ব বদলে যাচ্ছে,নেতৃত্বে আসছে তরুণরা।কিন্তু তারা শাসনের পরিবর্তে শোসন ও স্বার্থপরতার মন্ত্রণা পাচ্ছে অগ্রজদের কাছ থেকে।ফলে গ্রামে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিধান করা, আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি নিশ্চিত করা,শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর শাস্তি দেয়া ও শায়েস্তা করা, গ্রামের লোকদের মধ্যে বিরোধ,ঝগড়া-বিবাদ প্রভৃতি নিবৃত্তি করার চেয়ে পকেট ভারি করেই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।
গ্রামীণ বিচার বা সালিশ ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে;ন্যায় সঙ্গত না হওয়ায় সমাজ জীবনে প্রতিহিংসা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।আগে গ্রামে বসবাসকারীদের জীবনযাপনে নানাবিধ সমস্যা সমাধান করত গ্রাম্য সালিশ ব্যবস্থা। কিন্তু এখন গ্রাম্য সালিশ ব্যবস্থা মানুষকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ সালিশ ন্যায়সঙ্গত হয় না।ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত গ্রাম্য সালিশী ব্যবস্থাই গ্রাম্য উন্নয়নে পথে অন্তরায়।
জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে মানুষকে নতুন বা আধুনিক ছলাকলায় শোষণ করার জন্য গ্রামীণ সমাজে সৃষ্টি হয়েছে ধূর্ত,চাটুকার ও দূরভিসন্ধি সম্পন্ন মাতবর শ্রেণি।গ্রামীণ সমাজ নিয়ন্ত্রণ করা এসব মানুষের আসল চরিত্র এমন যে,ভালো মানুষেরা গ্রামীণ রাজনীতির মাতবরদের ঘূর্ণিপাকে পড়ে অনেক সময় টিকে থাকতে পারে না।
মাতবর ও চাটুকারদের কর্মকাণ্ড মানুষ নামের মানবিকতাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।তারপরও একজন খারাপ মানুষ সমাজের দশজন ভালো মানুষের চাইতে হয়তো শক্তিশালী,কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী।গ্রামীণ রাজনীতিতে কে কাকে হেয় করতে পারল,কার সমাজে দাপট বেশি, সামাজিক সংকটকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেয়ে বাইরের চাকচিক্যটাই এখানে মুখ্য বিষয়।এখানে দু:খী-নিপীড়িত-শোষিত মানুষের দুর্নাম রটিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্ঠা চলে।অনর্থক কাউকে ছোট করার প্রবণতা দেখা যায়।এরা সর্প হইয়া দর্শন করে,আবার ওঝা হইয়াও ঝাড়ে,কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে; সাধারণ শ্রেণির মানুষ নিষ্পেষিত হয়।
সমাজে শোষক মাতবর শ্রেণিরা দাপুটেয়ানা দেখাতে মরিয়া।চাটুকারদের কাছে অনেক সময় যোগ্যরা অসহায়।অযোগ্যদের দাপটে বা তদবিরে পাল্টে যাচ্ছে অযোগ্যদের তকদির। কিছু অসৎ মানুষের সমাজ নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা ও দৌরাত্ম্যে কলুষিত হচ্ছে সমাজ।গ্রামের কাউকে ধন-সম্পদে বা শিক্ষায়-দীক্ষায় উন্নতি করতে দেখলেই নানা ছলচাতুরি করে তাকে বিপদে ফেলেন,ধন-সম্পদ খোয়ায়ে সর্বসান্ত করার চেষ্টা করেন।ফলে সহজ-সরল-সৎ লোকেরা অসহায় হয়ে পড়ে।এরা সমাজের কাছে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চাইলেও তাদেরকে প্রকৃত অর্থে কেউই সম্মানের চোখে দেখে না।এসব দুষ্টু লোকেরা এতই চতুর যে,মারাত্মক অপরাধ করেও ধরাছোয়ার বাইরে থাকে।কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকেই উল্টো ফাঁদে পড়তে হয়, বিপদে পড়তে হয়।
সহজ-সরল ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ গ্রামের সাধারণ জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে এদের নীচতা,চরম সুবিধাবাদী পেশাদার কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ষড়যন্ত্রপ্রিয়রা যখন যে সরকার আসে তার পক্ষেই কাজ করে,সারাক্ষণ মামলা মোকদ্দমা ও বিচার সালিশ নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তিলকে তাল করে,প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ঘটনার ব্যাখ্যা নিজ সুবিধামতো করে তুচ্ছ ঘটনাকে বড় করে লড়াই বাধিয়ে দেয়। উপঢৌকন-ঘুষ আদায়ই হয় তাদের মূল উদ্দেশ্য।ভিলেজ পলিটিকসের নেতিবাচক প্রভাব অনেক সময় জাতীয় রাজনীতিকে আক্রান্ত করে,সঙ্কীর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করে।কখনও কখনও শহরের ডার্টি পলিটিক্স বা নোংরা রাজনীতির চেয়েও ভিলেজ পলিটিক্স বেশি মারাত্মক হয়ে ওঠে।

 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
								                                                                                     
                                    
 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                 
                                 
                                