তাজরিন ফ্যাশনের শ্রমিকের পোড়া গন্ধ এখন আমাদের নাকে লাগে না।ঢাকার নিমতলীর ১২৪ জন শ্রমিকের পোড়া গন্ধ আমরা এখন আর পাই না।রানা প্লাজার ধ্বংসের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তচিৎকার আমাদের কানে এসে এখন আর পৌঁছায় না।স্মার্ট গার্মেন্টসের পোড়া লাশ আমাদের স্মৃতিতে বিস্মৃতির বালুকাবেলায় বিলীন প্রায়।
ব্রেকিং নিউজের’ আল্টিমেট ‘ভোক্তা’ হিসাবে কিছুদিন আমরা গরম গরম এসব খবর ‘ভোগ’ করবো,কিছুদিন পর নতুন কোনও ‘ব্রেকিং নিউজ’নিয়ে মেতে উঠবো।পোড়া লাশের গন্ধ আর আমাদের নাকে লাগবে না।শরমহীনভাবে নতুন কোনও গরম খবর নিয়ে উত্তেজনায় মেতে উঠবো।এভাবেই চলছে,এভাবেই চলবে।
গত জুলাই মাসে নারায়ণগঞ্জের সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস এবং বেভারেজের কারখানার অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গলে যাওয়া ৫২ জন শ্রমিকের চেহারা আমাদের চোখে আর ভাসে না।সীতাকুণ্ডে পুড়ে যাওয়া মানুষের কয়লাও আমাদের কাছে অতীত হয়ে যাবে নিকট ভবিষ্যতে।এভাবেই চলছে এবং যেন এভাবেই চলবে।কিন্তু এভাবে আর কত?
আচ্ছা এত জন মানুষের এ নির্মম মৃত্যুর দায় কার?শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই মানুষের এ অপূরণীয় ক্ষতির পূরণ হয়ে যায়?১০ লক্ষ টাকা দিয়ে একটা জীবনের বিনিময় হয়?মানুষের শরীর পুড়ে কয়লা হওয়ার পর আমরা আবিষ্কার করি যে দাহ্য পদার্থ রাখারই কোনও অনুমোদন ছিল না।
কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে মহামানব সেজে সমাজে বহাল তবিয়তে দিন কাটায়।নতুন করে ব্যবসা শুরু করে নতুন করে বিত্তবৈভবের মালিক হয়।নতুন করে নতুন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার নতুন আয়োজন করে!
কেননা,এসব ঘটনার কোনও সুষ্ঠু বিচার হয় না। ১৯৯০ সালে সারাকা পোশাক কারখানায় আগুন লেগে আগুনে দগ্ধ হয়ে পোড়ে কয়লা হয়েছিল ৩২টি তাজা প্রাণ।আজকে ২২ বছরেও তার কোনও বিচার হয়নি।দোষীদের কোনও ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়নি।ফলে,তারা সমাজে বহাল তবিয়তে আছে।
একইভাবে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনারে পুড়ে যাওয়া লাশগুলোর হাহাকারও কোনও ন্যায়বিচারের আলো দেখবে কিনা সে সন্দেহ অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে জন্ম দেয়।বিচারহীনতার এ ‘সন্দেহ’ এবং‘সংশয়’ কোনোটাই মানুষ,মানবতা এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে সুখকর নয়।
তাই এর পরিবর্তন জরুরি।কেননা,এ পরিবর্তনই পোড়া মানুষের অভিশাপ থেকে এ সমাজকে মুক্তি দেবে।আমরা এখনও এই অভিশাপ থেকে মুক্ত নয় বলেই,সীতাকুণ্ডের আগুনে জ্বলছে এ দেশের সংবেদনশীল মানুষের বিবেক।
টাকাওয়ালারা টাকা দিয়ে মানুষ কিনবে,মানুষের জীবন কিনবে,এটা ‘দাসযুগের ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি’ হিসাবে জারি ছিল।কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও এই ‘দাসযুগের’ ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি বলবৎ থাকবে?এর চেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর কী হতে পারে!দেশের মানুষ আজ জানতে চায় আর কত মানুষের শরীর পুড়ে কয়লা হলে,শ্রমিকের লাশ পোড়ার এ সিরিয়াল বন্ধ হবে?

